এর তোলা সৌরজগতের বাইরের ছবি কেমন ?
25 ডিসেম্বর 2021, উৎক্ষেপণের পর তার 18টি দর্পণের দর্পনসজ্জা সম্পূর্ণ হয় 11মার্চ 2022 তারিখে। আর ঠিক তারপরেই পরীক্ষামূলকভাবে তোলা প্রথম ছবিটি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই বৈজ্ঞানিক মহলে গুঞ্জন শুরু হয় বর্তমান সময় অবধি মানবসৃষ্ট সর্বাধুনিক ‘স্পেস টেলিস্কোপ’ নিয়ে যার নাম ‘James Webb Space Telescope ‘(সংক্ষেপে JWST)
যতই দিন যাচ্ছে এই টেলিস্কোপের তোলা একের পর এক চোখ ধাঁধানো ছবি দেখে বৈজ্ঞানিকদের মহাকাশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরো বেড়েই চলেছে।
যাত্রাকালের এই অল্প সময়ের মধ্যই JWST আমাদের এমনসব অপূর্ব দৃশ্য দেখিয়েছে যার কৃতিত্ব পাওনা সেই সকল বৈজ্ঞানিকদের যারা এই টেলিস্কোপ বানানো থেকে শুরু করে তার কার্য পরিচালনার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন ।
এই JWST এর ইতিহাস এবং এর কাজ করার পদ্ধতি নিয়ে না হয় অন্য লেখায় বলা যাবে।
তবে সম্প্রতি JWST এর তোলা বিভিন্ন ছবির সংগ্রহে জায়গা করে নিয়েছে আরো যে চারটি ছবি তা মানব ইতিহাসেও প্রথম।
এই প্রথম আমাদের সৌরজগতের বাইরে কোনো গ্রহের ছবি আমরা এত স্পষ্ট এবং সরাসরি দেখতে পেলাম।
SPHERE
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিনেই অর্থাৎ 1লা সেপ্টেম্বর 2022, নাসা প্রকাশ করে আমাদের সৌরজগতের বাইরের কোনো গ্রহের ছবি। চারটি ছবিই একটি গ্রহেরই, যার নাম দেওয়া হয়েছে HIP 65426b, যা পৃথিবী থেকে 385 আলোকবর্ষ( আলো এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে 1 আলোকবর্ষ বলে) দূরে ‘Centaurus’ নামক নক্ষত্রমন্ডলে অবস্থিত।
গ্রহটি আমাদের কাছে যে একদম নতুন সেটা বলা ঠিক হবেনা কারণ এই গ্রহটি আদতে 2017 সালেই আবিষ্কৃত হয় এবং সেই সময় চিলিতে অবস্থিত SPHERE ( Spectro-Polarimetric High-contrast Exoplanet Research instrument)
নামক একটি বিরাটাকার টেলিস্কোপ দিয়ে এর ছবি তোলা হয়। তবে পৃথিবী পৃষ্ঠে অবস্থিত ওই টেলিস্কোপের মাধ্যমে গ্রহটি সম্পর্কে যতটা জানা সম্ভব হয়েছে, মহাকাশে অবস্থিত JWST এর মাধ্যমে জানা গেছে সেই গ্রহের সম্বন্ধে আরও অনেক তথ্য যা বৈজ্ঞানিকদের উচ্ছ্বসিত করে তুলেছে।
এবার আসি HIP 65426b প্রসঙ্গে। আগেই বলেছি গ্রহটি আমাদের পৃথিবীর তুলনায় 385 আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটি যেই নক্ষত্রের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করছে তার নাম HIP 65426 .
JSWT ( James Webb Space Telescope) এর তোলা ছবিগুলিকে বিশ্লেষণ
JSWT ( James Webb Space Telescope) এর তোলা ছবিগুলিকে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন যে গ্রহটি আমাদের বৃহস্পতি গ্রহের মত গ্যাসীয় পিন্ড অর্থাৎ এখানে আমাদের পৃথিবীর মত কোনো ভূপৃষ্ঠ নেই। তাই আপাতত গ্রহটি আমাদের বসবাসের অযোগ্য। পুরো গ্রহটি বিভিন্ন গ্যাসের সমন্বয়ে তৈরি এবং বৃহস্পতির তুলনায় ছয় থেকে বারো গুন বড়। গ্রহটি পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যেকার দূরত্বের 92গুন(যাকে আমরা 92AU বলে থাকি) দূর থেকে HIP 65426 নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে। এত দূরে থেকে প্রদক্ষিণ করায় নিজের সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় 630.7 বছর।
তবে আমাদের পৃথিবীর তুলনায় গ্রহটির বয়স খুব কম। কারণ আমাদের পৃথিবীর বয়স যেখানে 450 কোটি বছর সেখানে HIP 65426b এর বয়স মাত্র 1.5 থেকে 2 কোটি বছর।
এখন অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন কেনো এত বড় বড় টেলিস্কোপে থাকা সত্ত্বেও আমরা এর আগে সৌরজগতের বাইরের কোনো গ্রহের এত ভালো ছবি সহজে তুলতে পারিনি? এর পশ্চাতে কিছু কারণ রয়েছে।
প্রথমত, আমরা জানি গ্রহের নিজস্ব কোনো আলো নেই এগুলি তাদের নক্ষত্রের আলোকে আলোকিত হয়। তাই কোনো গ্রহ যদি তার নক্ষত্রের থেকে অনেক দূরে থাকে এবং সেখানে যদি সেই নক্ষত্রের আলো না পৌঁছায় তবে সেই গ্রহের ছবি তোলা একরকম অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, গ্রহের আকার নক্ষত্রের তুলনায় নগণ্য হয় এবং আমাদের থেকে এগুলি এতটাই দূরে যে আমরা এইসব গ্রহের ছবি তুলতে পারিনা।
তৃতীয়ত, যদি কোনো গ্রহ তার নক্ষত্রের কাছেও থাকে এবং আকারে বড়ও হয় তবুও আমরা তার ছবি তুলতে পারিনা কারণ সেই গ্রহের নক্ষত্রের আলো গ্রহের আলোকে ছাপিয়ে যায় ।
তাহলে প্রশ্ন হলো এক্ষেত্রে এই অসম্ভব কাজটি কিভাবে সম্ভব হলো?
তার উত্তর হল গ্রহটি আকারে অনেকটাই বড় এবং নিজের নক্ষত্রের থেকে এমন একটা দূরত্বে রয়েছে যে টেলিস্কোপটি সহজেই গ্রহকে নক্ষত্রের থেকে আলাদা করতে সক্ষম হয়েছে।
তবে এক্ষেত্রে জেনে রাখা ভালো যে আমরা যেই ধরনের ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি তুলে থাকি এই টেলিস্কোপে সেই ধরনের কোনো ক্যামেরা নেই। JWST তে প্রধানত যে দুটি ক্যামেরা রয়েছে তার নাম Near-Infrared Camera (NIRCam) এবং Mid-infrared Instrument (MIRI). এগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ইনফ্রারেড আলোর সাহায্যে ছবিগুলি তোলা হয়েছে। আসলে অনেক দূরের কোনো উৎস থেকে আলো আসার সময় এই দীর্ঘ যাত্রাপথে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ত্রমশ বাড়তে থাকে এবং সেই আলো ইনফ্রারেড তরঙ্গে রূপান্তরিত হয় ফলে খালি চোখে বা সাধারণ ক্যামেরার মাধ্যমে তাকে দেখা সম্ভব হয়না । কিন্তু JWST তে যেই NIRCam এবং MIRI রয়েছে সেগুলি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ইনফ্রারেড আলো গ্রহণ করতে সক্ষম। তাই আমরা এর মাধ্যমে অনেক নতুন তথ্য আবিষ্কার করতে পেরেছি।
JWST এখন আমাদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ কারণ JWST যেভাবে একের পর এক ছবির মাধ্যমে নতুন রহস্য উন্মোচন করছে আশা করা যায় ভবিষ্যতে আমরা মহাকাশের উৎস সম্বন্ধে আরও অনেক তথ্য জানতে পারবো। কে বলতে পারে, হয়তো এই JWST এর হাত ধরেই আমরা নতুন কোনো পৃথিবীর সন্ধান পেয়ে যেতে পারি যেখানে জীবন বিদ্যমান ?