ত্রিকোণ প্রেমের গল্প

ত্রিকোণ (1)

আজ দশটা বছর হয়ে গেল আজও তাঁর বাড়িতে এই দিনটায় তাড়াতাড়ি ফেরার কথা কি মনে থাকে না? এইটুকুই ভেবেছিল হঠাৎ ‘পি’ করে গাড়ির হর্ন বেজে উঠল। খুব চেনা গাড়ির শব্দ শুনে ছুটে দরজা খুলতে গেল মৌ। কই দরজার বাইরে তো কেউ নেই। তবে যে গাড়ির আওয়াজ শুনলাম। একটু ঝুকে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল সে। হ্যাঁ একটা আওয়াজ পাচ্ছে। না না একটা না দুটো। একটা বোধহয় লেডিস হাই হিলের আওয়াজ। তবে কি ,পাশের ফ্ল্যাটের ওই ছেলেটা? তাহলে মৌ এর দরজাটা বন্ধ করে দেওয়াই উচিত কারণ ছেলেটা বড্ড অন্যভাবে তাকায়। ভালো লাগে না ওর চাউনিটা।খানিক তাকিয়ে দেখতে পেল একজন মাতাল লোককে একটি মেয়ে ধরে নিয়ে আসছে, হয়তো না ধরলে লোকটি পড়েই যেত।

সামনে আসতে মুখটা চিনতে পারল। লোকটা আরও কাছে এগিয়ে আসতে মৌ মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ঘরে ঢোকার দরজা থেকে সরে দাঁড়াল।কোনো কথা না বলে মেয়েটি লোকটাকে ঘরে নিয়ে গেল, একেবারে শোবার ঘরে নিয়ে খাটে ফেলে দিল,যেন তাঁর খুব পরিচিত এ বাড়ির ঘরগুলো। বেরিয়ে আসবার সময় নজরটা ডাইনিং টেবিলে এমনিই পড়ে গিয়েছিল।ঘরের বাইরে তখনও মৌ ঠায় দাঁড়িয়ে। চোখে জল নেই যেন পাথরমূর্তি।মেয়েটি বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মৌয়ের সামনে একটুক্ষণ দাঁড়ায় হয়তো কিছু বলতে… তাঁর আগেই মৌ বলে ওঠে –

মৌ বলে ওঠে

“আজকের দিনটাও ছাড়লে না? “ বলে কোনো উত্তর প্রত্যাশা না করেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। তাঁর দশ মিনিট পর গাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ শোনে…ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে চোখের কোণটা জলে ভিজে ওঠে। বুকের মধ্যে অজানা কষ্ট পিষে দিয়ে যায় যেন মনের মধ্যে কেউ রোলার কোস্টার চালিয়ে যাচ্ছে। এটা তো নতুন নয়। রোজকার এক ঘটনা।তবে হয়তো বিশেষ দিন বলেই কষ্টের পরিমাণটা বেশি।ডাইনিং টেবিলে থাকা খাবারগুলো ফ্রিজে তুলে ঘরে একবার উঁকি দেয়, দেখে  তাঁর দশ বছরের ছোট্টো ছেলেটা ঘুমাচ্ছে।দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে যায়। খাটে উঠে বালিশে মাথা ফেলে, পায়ের কাছে থাকা চাদরটা বুক পর্যন্ত টেনে নেয়।

তাঁর পাশে এখন একটা কলের পুতুল শুয়ে আছে। আজ… না আজ না গতকাল তাদের বিবাহবার্ষিকী ছিল।১৭ই মার্চ। তাকে “আজ” বলা চলে না, এখন তো রাত আড়াইটে। ঘাড় ঘুরিয়ে তেরো বছরের পরিচিত কলের পুতুলটার দিকে তাকায় সে। বোঝার চেষ্টা করে দোষ কার….নিজের? তাঁর ভাগ্যের? নাকি ঋষির? নাকি ওই মেয়েটার কি যেন নাম…… জো…. জো…. হ্যাঁ, জোনাকি। আর একটা নাম মনে পড়তে থাকে, ‘শৈবাল’। শৈবাল… শৈ… শৈ মুখে নামটা উচ্চারণ করতে গিয়ে চোখের জলে অর্ধেক বালিশ ভিজিয়ে ফেলে। নিঃশব্দ কান্নায় খুবই পটু হয়ে উঠেছে মৌ। কতক্ষণ ঠিক কেঁদেছে মনে নেই তবে কাঁদলে বোধহয় শরীর দুর্বল বোধ করে আর সে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে।

ত্রিকোণ (2)

পরেরদিন

পরেরদিন ঘুম ভাঙল যখন বেলা ন’টা। বাপ-ছেলের কথার আওয়াজে ঘুম ভাঙতেই মৌ ধড়ফড় করে উঠে বসল। নাহ্!!একটা বিহিত করতেই হবে… ডাইনিং এ গিয়ে দেখল ঋষি ছেলের সাথে গল্প করছে, নিতান্তই সাধারণ গাড়ি সংক্রান্ত কোনো গল্প হবে।

ঋষি…. একবার শুনবে! (জোরে ডাকে মৌ)

ঋষি খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার ছেলের সাথে পুরোনো বিষয় নিয়েই গল্প শুরু করে।

চুপ থাকতে না পেরে মৌ ছেলেকে গিয়ে ধমক দেয় –

পড়াশুনো নেই? যাও পড়তে যাও।

মায়ের বকুনি খেয়ে টুবাই চেয়ার থেকে নেমে চলে যায়।

ঋষি কোনো কথা বলে না। খানিক চুপ থেকে মৌ বলতে শুরু করে-

“ডিভোর্সটা দিয়ে দিলেই তো জোনাকিকে নিয়ে থাকতে অসুবিধা হয় না। গত দশটা বছর হয়ে গেল।মুখের কথা নয়। সমস্ত লাম্পট্য আমি সহ্য করি তোমার। বাড়িতে কিছু বলতে পারিনা কারণ প্রেমটা আমি করেছিলাম। কলেজে তোমার পিছনে আমি দিন-রাত ঘুরে বেড়াতাম একরকম জেদ করেই আমি তোমায় বিয়ে করেছিলাম।

ভুল করেছিলাম আর তার শাস্তি আমায় দশটা বছর পেতে হচ্ছে। এবার আর না আমি ছেলেকে নিয়ে চলে যাবো তুমি ডিভোর্সের পেপার গুলো দিয়ে দিও। “

“কোথায় থাকবে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে? কে থাকতে দেবে তোমায়? শৈবাল?” (এতক্ষণে ঋষি কথা বলে)

শৈবালের নাম শুনে মৌ যেন রাগটাকে আর সামলে রাখতে পারে না।কাছে এগিয়ে গিয়ে ঋষির গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দেয়।

এমন কষাঘাতের জন্য ঋষি তৈরি ছিল না।খানিকটা হতভম্ব হয়ে যায়।

 তারপর কয়েক ঘন্টা পর রবিবারেও কোথায় যেন বেরিয়ে যায়।মৌ নিঃশব্দে সবকিছু দেখে…

ত্রিকোণ (3)

ঋষির আগমন

“জোনাকি দরজা খোলো…জোনাকি… জোনাকি…”

ওকি ঋষি তুমি এখন এত সকালে? এনি প্রবলেম? তুমি ঠিক আছো?

একগ্লাস জল হবে?

একমিনিট

এই নাও।(জোনাকি জল দেয়)

ঢকঢক করে গ্লাসের পুরো জলটা শেষ করে ঋষি বলে

 “মৌ আমায় কোনোদিন শান্তি দেয়নি। টুবাইকে পর্যন্ত কেড়ে নিচ্ছে। দিনদিন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে সম্পর্কটা।আমি আর পারছি না এ সম্পর্কে…” বলতে বলতে কেঁদে ফেলে।

“রিল্যাক্স! ঋষি তোমায় তো আগেই বলেছিলাম ডিভোর্স ফাইল করতে, তুমিই তো নাকে কান্না শুরু করলে। দেখো আমি কি বলব!! “বলে চাপা ঠোঁটে আলতো হাসির রেখা ফুটে ওঠে সাহিত্যিকের ভাষায় যাকে মৃদু বলে। এ চাপা হাসির নাগাল পাওয়া ঋষির কম্ম নয়। হয়তো… মৌ এর ও নয়।টেবিলের ওপর হাত দিয়ে ঋষি মুখ ঢেকে মাথা গুঁজে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করে আর মনে মনে জোনাকির প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতার বৃষ্টি ঝরায়। হয়তো ভাবে, জোনাকি না থাকলে তাঁর পরিস্থিতি কী হতো? কে দিতো এত সান্ত্বনা? সুপরামর্শ!!?

জোনাকি রান্নার তোড়জোড় করতে করতে এগিয়ে আসে বলে,

“শোনো আজ এখানেই থেকে যাও।রান্না-বান্না করছি খাওয়া দাওয়া করো তারপর সুখটান দিতে দিতে ইংলিশ মুভি।নিউজ এন্ড অল আমাদের দুজনের কেউই পছন্দ করি না। নিউজ তো আমরা তৈরি করি। এক্কেবারে জমজমাট রোববার!”    বলে জোরে হেসে ওঠে।

“রাতে বাড়ি ফিরে যেও বেশি কারও সাথে কথা বলার দরকার নেই। এখানে ডিনার করেই যেও রাতে জাস্ট গিয়ে শুয়ে পড়বে। আবার আ্যাস ইউসুয়াল কাল থেকে অফিস। “

কথাগুলো কতটা ঋষির কান দিয়ে ঢুকে মাথায় পৌঁছায়, বোঝা যায় না। জোনাকি খানিকটা এগিয়ে আসে আর ঋষির গালে হাত রেখে ঋষির নাম ধরে ডাকে।

“ঋষি!! ঠিক আছে তো? “

আনমনে একদিকে তাকিয়ে ঋষি “হু” বলে।

হয়তো টিভিতে চলা খবরে দেখানো মৃত্যুসংক্রান্ত হেডলাইনস্ টাই পড়ছিল ঋষি –

।। ত্রিকোণ প্রেমের জেরে খুন স্ত্রী,পলাতক স্বামী ; তদন্ত করছে বসিরহাট থানার পুলিশ ।।

                         ত্রিকোণ      (4)

কলেজ প্রেম

কলেজ প্রেম…শৈবাল দত্তের গিটার হাতে পাগলামি তাও শুধুমাত্র মৌমিতার জন্য। মৌ এর পছন্দ ছিল না তা নয়। ভালো হয়তো লাগতো…হয়তো কি!!! লাগতো.. বেশ লাগতো…ওই গুলাবি আঁখে গানটা… চোখ বোজে মৌ। কিন্তু ঋষি তারার মতো টুপ করে খসে পড়ে হঠাৎ প্রেম নিবেদন করে বসে সেসময়। ঋষি আর শৈবালকে ভালো লাগার পরিমাপটা দাঁড়িপাল্লায় হিসেব করলে শৈবালের দিকেই দাঁড়িপাল্লা ঝোলে একটু বেশি।

“কিরে, ওই ছেলেটাও তো প্রপোজ করে বসল। আমাদের মৌ এর কি ডিমান্ড কিন্তু এ তো ওই ভ্যাগাবন্ড টার জন্যই ওত পেতে আছে। হিহি!! “

হাসতে থাকে অনিমা, সুমেধারা।

মৌমিতার থার্ড ইয়ার ইউ.জি ইংরাজি আর শৈবাল, সেও ইংরাজি তবে পি.জি সেকেন্ড ইয়ার। দাদা বলে ডাকাই উচিত কিন্ত মৌ “দাদা” বলে সম্বোধন কখনো করেনি। প্রথম দিকে শৈবালদা মৌ কে পাত্তা দিত না। পাত্তা পাচ্ছিল মৌ ঋষি প্রোপোজাল দেওয়ার পর থেকে। সত্য পাঠক কি বিচিত্র এই মনস্তত্ত্ব। যখন মৌ চায়ের দোকান থেকে উঁকি দিত তখন শৈবাল মুখ ফিরিয়ে ট্রামে উঠত লাফিয়ে আর আজ… আজ যখন ঋষি-মৌ চা খাচ্ছে দাঁড়িয়ে তখন মৌ এর চোখ টানার নিজের ওপর কি ভীষণ চেষ্টা!!

মৌ বুঝতে পেরেছিল আড়ালে ঘটনা কি ঘটছে। সেও মনে মনে বেশ আনন্দ মাখছিল। যেমনটা সিনেমায় হয়। নায়িকা মজা লুফে নেয়। কিন্তু বিধাতা!!

এই হাতে হাত,চোখে চোখ রেখে দীর্ঘদিন ধরে চা খাওয়ার সিন কোনো এক বিপজ্জনক দিনে চোখে পড়ে মৌ এর বাবার। ব্যাস!! আর বুঝি রক্ষে নেই। তারপর…….

তারপর যা হয় বাড়িতে অশান্তি, বাবার কড়া শাসন, ঋষিকে শাসানোও হয় আলাদা করে এবং মৌ কে বাড়িতে আটক রাখা।

সবগুলো ঠিক আছে তবে ঋষিকে শাসানোটা যেন অযৌক্তিক মনে হচ্ছিল মৌ এর।কারণ জানেনা তবে বাধ্যতামূলক হয়ে উঠছিল ঋষির কাছে ক্ষমা চাওয়াটা।

বহুদিন পর ছাড়া পেয়ে মৌ যেদিন প্রথম আবার কলেজ গিয়েছিল,অনেক আকুতি মিনতি করে ঋষিকে রাজি করিয়েছিল চা খেতে যেতে। রাজি হয়নি ঋষি। অনেক চেষ্টার ফলস্বরূপ যখন ঋষি -মৌ সেই একত্রে দাঁড়িয়ে চায়ের দোকানে তখন উল্টোদিকের বেঞ্চে শৈবাল ছিল না।

হাতে হাত লাগে আবার। এবার মৌ এর হাত ধরে ঋষির। মন থেকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এটা মাস্ট।শৈবালদা নেই। এটাই শান্তি মৌ এর। সে বসে থাকলে মন থেকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য হলেও হাত ধরতে পারত না মৌ ঋষির।

কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস! আবারও সে দৃশ্য চক্ষুগোচর হয় মৌ এর বাবার।

সেবারের বোমাটা রাস্তাতেই পড়েছিল। সহ্য করতে পারে না মৌ। চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

“হ্যাঁ আমি ঋষিকে ভালোবাসি, বড্ড ভালোবাসি আর ওকেই বিয়ে করব। যতই সময় লাগুক”

বলে মাটির দিকে তাকায় তারপর মাটি থেকে মুখ তুলে দেখতে পায় শৈবালকে।

তটস্থ শরীর, থমথমে মুখ, শুকনো চোখ আর কাঁপা ঠোঁট। হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে মৌ। শৈবাল নয় , ওর গলায় ঝোলা চাবিটা আর প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণাটার কথা ভেবেই মৌ এর নিজেকে অপরাধী মনে হয়,বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।

ত্রিকোণ (5)

মৌ বুঝেছিল কি হয়েছে, কি হচ্ছে আর কি হবে। আমরা প্রত্যেকেই নিজেরটা বুঝি। নিজ সুখের হিসেব মেলাতে আমরা প্রত্যেকে স্বার্থপর। নিজের সুখ খুঁজে নিতে যদি একটু ধূর্ততা দেখাতেই হয় তাহলে মৌ কে ধূর্ত বললে বলা যায়, তবে..বিচারে একটু ভুল হয়ে যেতে পারে।

খষিকে এবার দেখা যায় মৌ কে একটু এড়িয়েই চলতে।

কিন্ত মৌ এর আচরণ একেবারে দক্ষিণগামী।ঋষির পায়ে নিবেদিত প্রাণ। ঋষি ছাড়া কিছু বোঝে না। সারাদিন ঈশ্বরের অষ্টনাম জপের মতো মুখে মেয়ের একটাই নাম, “ঋষি”

ঋষি, শৈবাল সমবয়সি। ইউনিভার্সিটি পাস করার পরই চাকরি পেয়ে যায় ঋষি। শৈবাল বসে থাকে। সমাজ তাকে ‘বেকার’, ‘বাউণ্ডুলে’ বলে ডাকে। আচ্ছা মৌ কি ভবিষ্যতটা দেখতে পায়? সব মেয়েই বোধহয় পায়। সমাজ যে ‘বিয়ে’ ,’সংসার’, ‘ভালো থাকা’ নামক ভারী শব্দগুলো ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে।

“মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম,

তোমারই কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল যখম”

বিয়েটা পালিয়েই করেছিল মৌ-ঋষি। বাড়ির মুখ পুড়িয়েছে মেয়ে। তাকে মেনে নেয়নি বাড়ির লোক। বিয়ের পর তাদের একটি ছেলেও হয়। সুখ বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু কোথা থেকে এসে পড়ে জোনাকি। তৃতীয় ব্যক্তির মাঝে আসাটা তিনজন ব্যক্তিরই জীবনের মোড় ঘোরায়। মৌ তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ভালোই জানে তবে পচনটা কোথায় লাগবে আর কোথায় সারবে সেটাই চিন্তার… “            

দিন গড়িয়ে চলে। সময়কে যদি বাঁধা যেত তবে পৃথিবী ধ্বংস হতো।সব চলে, সবব হয়। হয়না শুধু মৌ আর খষির কথা, হয়না সংসার। ওদের ঝগড়ার রাশ এতই ভারী যে দুজন ভুলেই গেছে ছোটো ছেলেটার ওপর কি প্রভাব পড়তে পারে এ ঝগড়ার।

ত্রিকোণ (6)

অফিসের কেবিনে বসে ছিল জোনাকি। ফোনে খোলা ছিল কিছু একটা সম্ভবত কোনো ছবি। পিছনে আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ায় ঋষি। জোনাকি বুঝতে পেরেই উঠে দাঁড়ায়।

“ঋষি! কখন এলে? সরি, একদম খেয়াল করিনি।“

ঋষি বলে, “কি দেখছিলে?আমাকেও দেখাও। বয়ফ্রেন্ড নাকি? “

“হোয়াট! নো! আমি ক্রাইম পেট্রোল দেখছিলাম। একটা শো। ওটারই আ্যক্টর। তুমিও যেমন মজা করো। “

পাঠক বলবেন জোনাকি কথা ঢাকার চেষ্টা করল কিন্তু ঋষি কি বলবে?

“এইজাতীয় শো, নিজউ তো পছন্দ না বলেই জানতাম। তা এসবের প্রতি আ্যডিকসন কবে থেকে? “ঋষি হাসে। একেবারে সাধারণ হাসি।

জোনাকি কিছু বলে না। ঋষির ফোনটা নিয়ে ক্রাইম পেট্রোলের কিছু এপিসোড খুলে হাতে ধরিয়ে দেয় আর যাওয়ার সময় বলে,

“ঠিক রাত আটটা, সুপার ক্যাসিনোভা, বার কাম রেস্টোরেন্টে দেখা হচ্ছে। গুডবাই!! “

জাস্ট একবার দেখার সুযোগ পেয়েছিল ঋষি জোনাকির ফোনের ছবিটা, খুব চেনা লেগেছিল। ওটাই দেখার লোভে নাকি জোনাকি হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল বলে, বোঝা যায় না তবে সেই নামজাদা শো এর এপিসোড গুলি বসে দেখতে থাকে ঋষি। দেখতে দেখতে কখন সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতে পারেনি।নেশা লেগে গিয়েছিল। যখন ফোনের ঘড়িতে চোখ পড়ল আটটা বেজে পনেরো। তড়িঘড়ি করে লাফিয়ে উঠে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঋষি।

“দেরি হয়ে গেল অনেকটা তার ওপর এই সিগন্যাল। উফ্! জোনাকি রাগ করবে না তো! “

যে মানুষ ক্রাইম শো দেখে না সে জীবনে প্রথমবার ক্রাইম শো দেখলে একটিবারের জন্যে হলেও অন্তত নেশাতুর হয়ে পড়েই। শুধু তাই নয় সারা মাথা জুড়ে চলতে থাকে তার দেখা টুকরো টুকরো ছবি। মাথা প্রথম থেকেই ঘেঁটে থাকে তাই সেসময় শান্তির প্রয়োজন পড়ে তার বদলে অশান্তি আসলে মানুষ জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। নিজের প্রতি দখল থাকে না।

গাড়ি পার্ক করে এগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখে জোনাকিকে দেখতে পায় ঋষি। কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল হেসে। ঋষি গিয়ে সহজভাবে কাঁধে হাত রাখতেই জোনাকি চমকে উঠে পিছন ফেরে এবং ফোন কেটে দেয়।

“সরি জোনাকি একটু দেরি হয়ে গেল আসলে… “

কথাটা ঋষিকে শেষ করতে দেয় না জোনাকি। বলে ওঠে, “শাট আপ! জাস্ট শাট আপ! “

এরপর দাঁতে দাঁত চেপে উল্টোপাল্টা যুক্তি দিয়ে দেরি করে আসার ফলাফল বোঝাতে থাকে। বহুবার মৌ এর প্রসঙ্গও তুলে আনে। মৌ এর অশান্তি র কথা বারবার মনে করিয়ে তাঁর অভালোবাসার কথা বলে ঋষির জীবন আসলে কতটা দুর্বিপাকগ্রস্ত আর তাকে আগলে রাখতে গিয়ে জোনাকির জীবনেও কি কি সমস্যা সেসব কথা তুলে আনে জোনাকি।

ঘটনা সামান্য এবং বিষয় অপ্রাসঙ্গিক। ঋষি বুঝতে পারে না হলো কি? জেনাকির ব্যবহারে এতো বদল!!

জোনাকি চলে যায় হনহনিয়ে। বেরিয়ে যায় ওখান থেকে।

বেরোয় না ঋষি। সোজা সিঁড়ি দিয়ে চলে যায় বারে। পেগ নিতে নিতে জোনাকির কথা গুলো ভাবতে থাকে। কানে বাজে ক্রাইম শো এ দেখা সেই প্রতিশোধের চাপা গোঙানি। নেশার পারদ চড়তে থাকে। নেশাগ্রস্ত উন্মাদের মতো তাঁর মস্তিষ্ক ছুটে চলে শান্তির আস্তানায়।

                              ত্রিকোণ (7)

রাত বারোটা, বৃহস্পতিবার

ডাইনিং টেবিলে হাত রেখে ঝিমোতে ঝিমোতে ঘুমিয়েই পড়েছে মৌ।

দরজায় কলিং বেল বাজতেই ওঁর ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বারোটা। ঋষির তো আসার সময় হয়নি তাহলে কি সেই পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটা এলো! এত রাতে কি মতলব?

ভাবতে ভাবতে আবার বেল বেজে উঠল। এবার একসাথে তিনবার।

দৌড়ে গেল মৌ রান্নাঘরে।তুলে নিল সবজি কাটার চাকুটা।

আবার বেল বাজলো, দুবার…

চাকুটাকে পিছনে রেখে দরজা খুলতেই ঋষি খানিকটা মৌ এর গায়ের দিকে ঝুঁকে এলো। মুখের বিশ্রী মদের গন্ধে মৌ নাক কুঁচকে মুখটা ফিরিয়ে নিল ঠিকই কিন্তু হাতটা বাড়িয়ে দিল ঋষির কাঁধটাকে ধরে রাখতে।

এমন সময় মৌ এর হাতে থাকা চাকুটা ঋষির চোখে পড়ে। মৌ তাকে ধরে সোফায় বসায়।চাকুটাকে সামনের টি টেবিলে রেখে রান্নাঘর চলে যায়। ঋষি নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন অবস্থায় অনেক কিছু কল্পনা করতে থাকে। মৌ, শৈবাল, ওদের প্রেম। ঋষিকে বিয়ে। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প, স্বামীকে ঠকানো, স্ত্রীর দ্বারা স্বামী খুন ইত্যাদি যা সে ক্রাইম শো তে দেখেছিল।

এমন সময় চোখে পড়ে টি টেবিলে রাখা একটা ম্যাগাজিন ,আধখোলা উল্টো করে রাখা। হয়তো মৌ পড়ছিল।

ঋষি উল্টে দেখল আ্যলগির ছবি আর তার বর্ণনা।

আ্যলগি!!….. আ্যলগি!!….

মনে মনে কি যেন হিসাব মেলাতে মেলাতে চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল ঋষির।

মৌ ডাইনিং এ ফিরে আসতেই তার মুখ দেখে রাগে মাথা গরম হয়ে গেল ঋষির ম্যাগাজিনের কথা তুলে অযথা ঝামেলা শুরু করে। আসল বিষয়টা মৌ বোঝে না এরপর তোলে শৈবালের কথা, সেইসব পুরোনো কথা। হিসেব -নিকেশ, লাভ ক্ষতি। যখন মৌ প্রতিবারই ঋষিকে অকাট্য যুক্তিতে হারাতে থাকে, ঋষির মাথায় রক্ত চেপে যায়। বাইরে জোনাকির প্রত্যাখ্যান, যে জোনাকি চিরকাল সমর্থন করেছে তাঁর দুর্ব্যবহার আর এখন বাড়িতে তেরো বছরের অশান্তি।

জীবনে সে পেল কী?

এইসব ভাবতে ভাবতেই মুখ নয় এবার হাত চালায় ঋষি। আ্যালকোহলের নেশায় নিজেকে সংযত রাখতে পারে না।

ঠাস করে চড় মেরে দেয়। মৌ সামলে নেওয়ার আগেই তাঁর চুল ধরে ঠেলে দেয় সেগুন কাঠের তৈরি টি টেবিলটার ওপর। নাকে সজোড়ে লেগে টেবিলের কোণে প্রচন্ড রকম রক্তপাত হয় এবং প্রায় জ্ঞানলোপের অবস্থা হয় মৌ এর। সেদিকে কোনোরকম খেয়াল না করেই মাথা ধরে ঠুকতে থাকে টেবিলের ওপর ঋষি।

বাইরের ঘরে হওয়া আওয়াজে টুবাইয়ের ঘুম ভাঙে। ছোটো ছোটো পায়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়, পর্দার পিছনে। নিঃশব্দে দেখে যায় সমস্তটা।

ছোট্টো দুটো চোখ অনেক কঠিন বাস্তবের সাক্ষী। স্পষ্ট দেখে সে তাঁর বাবা, টেবিলের ওপর থেকে চাকুটাকে তুলে নেয়। শক্ত মুঠোয় ধরে চাকুটাকে, তারপর অনভিজ্ঞ হাতে ধারালো চাকু চলে মায়ের অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা শরীরের গলার নলিতে।

ত্রিকোণ (8)

পরদিন সকাল আটটা, জোনাকির টিভিতে খবরের চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ আর হেডলাইনস্

।।সন্দেহজনকভাবে মৃত্যু স্ত্রীর, পলাতক স্বামী।।

 জোনাকির ফোনের স্ক্রিনে সেই লোকটার ছবি, ফোন এসেছে।

ফোনটা ধরল জোনাকি , ওপার থেকে ভেসে এল পুরুষ কন্ঠ, “ওয়েল ডান জোনাকি!!  কনগ্র্যাচুলেশন!! “

জোনাকি মুখে রহস্যজনক হাসি হেসে বলল,

“থ্যাংকস্ শৈবাল দা” …

More by dipayan bose

View profile