রসগোল্লার ইতিহাসের মূলকারণ
রসগোল্লা শুধু একটা মিষ্টি নয় বাঙালির জীবন যাপনের সঙ্গে জুড়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। কিন্তু রসগোল্লা কি বাংলার মিষ্টি? নাকি উড়িষ্যার? বাঙালির রসগোল্লা তথা কলকাতার রসগোল্লা সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের রসগোল্লার পার্থক্য কোথায়? রসে ভরপুর রসগোল্লা যে বাঙালির প্রিয়তম মিষ্টি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কলকাতার রাস্তা থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনের করিডোর পর্যন্ত রসগোল্লা গোটা ভারতেরই অন্যতম জনপ্রিয় মিষ্টি।তবে রসগোল্লা কোথায় বিখ্যাত এ কথা বলতে গেলে শুধু ভারতের নাম ই আসেনা।রস গোল্লা গোটা উপমহাদেশে ই বিপুল ভাবে জন প্রিয়। তবে মূল উড়িষ্যা বা বাংলা রসগোল্লার টিকায় যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক রসগোল্লাকে ইংরেজিতে কী বলে? রসগোল্লার তেমন কোন ইংরেজি অর্থ নেই তাই রসগোল্লাকে ইংরেজিতে রসগুল্লা (Rasgulla) বলেই ডাকা হয়।
রসগোল্লার সবচেয়ে পুরনো লিখিত ইতিহাস
১৭০ বছরের কিছু আগে, তার চেয়ে কম ও সবচেয়ে জনপ্রিয় দাবি দেড়শ বছর আগেকার। দুটি দাবিই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক হলে ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যের রসগোল্লার সাথে বাংলার রসগোল্লার স্বাদে ও উপাদানে পার্থক্য আছে। ধারণা করা যায় যে, রসগোল্লা তৈরির মূল উপাদান ছানা এক কালে ভারতবর্ষের মানুষ তৈরি করতে পারতেন না। তবে সম্ভবত এ ধারণাটা একদমই সঠিক নয়। কারণ জানা যায়, আনুমানিক নয় হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ভারতীয় ভূখণ্ডে কৃষি ব্যবস্থার সূচনা ঘটে। বৃক্ষরোপণ, শস্য উৎপাদন ও পশুপালন ছিল প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থার মূল উৎস। পশু পালন প্রথার ইতিহাস এত দীর্ঘ হলে ভেবে নেওয়া সঙ্গত নয় যে, ভারতবর্ষে দুধ ও ওই জাতীয় বিভিন্ন খাবারের প্রচলন বহু আগেই শুরু হয়েছে।
বাংলা অঞ্চলের মানুষও সেই ভাবেই ছানার ব্যবহার শিখেছে এটা মেনে নেওয়া কিছুটা কঠিন বটে, তবে প্রাচীন ভারতে ছানা কিংবা ছানা দিয়ে তৈরি করা খাবারের প্রচলন সীমিত ছিল। তবে বর্তমান নাগরিক জীবনে রসগোল্লা ছাড়া বাঙালির উৎসব পার্বণ ঠিক জমে ওঠেনা। বাংলাদেশ, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের রসগোল্লার মধ্যে বাঙালির রসগোল্লায় বেশ কিছু মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলায় ছানা দিয়ে তৈরি নরম ও স্পঞ্জরসগোল্লা। এটি মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই গলে যায়। বাংলায় রসগোল্লা তৈরিতে ময়দা ও সুজি একেবারেই ব্যবহার করা হয় না। এতে মিষ্টত্ব আনার জন্য চিনির রসে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই এটি দেখতে ধবধবে সাদা রঙের হয়।
পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যায় রসগোল্লার ইতিহাস
এই রসগোল্লা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যার মধ্যে চুলোচুলি ও দীর্ঘদিনের। একদিকে যেমন বাঙালিরা রসগোল্লাকে নিজেদের ঐতিহ্য মনে করেন, তেমনি অন্যদিকে রসগোল্লাকে উড়িষ্যা তাদের আবিষ্কার বলে মনে করে। পিছন ফিরে তাকালে রসগোল্লার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে নানা মুনির নানা মতামত রয়েছে। তাহলে চলুন আজকের এই নিবন্ধ থেকে জানা যাক রসগোল্লার ইতিহাস এর পিছনে মূল কারণ। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই যে, প্রশ্নটা সবার আগে উঠে আসে সেটা হলো রসগোল্লা কে আবিষ্কার করেছিল।এ নিয়ে অবশ্য নানা মুনির নানা মত রয়েছে। অনেক ওড়িশি বিশ্বাস করেন, এই মিষ্টির জন্মস্থান উড়িষ্যার পুরীতে।
উড়িষ্যার মানুষ জনের মতে রসগোল্লার আবিষ্কারক
কিংবদন্তি অনুসারে, ভগবান জগন্নাথদেব স্ত্রীকে না জানিয়ে রথ নিয়ে বেরিয়ে পড়ায়, তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী মাতা রুষ্ট হন। তিনি রথ নিয়ে জগন্নাথ দেব কে মন্দিরে ঢুকতে দেবেন না বলে সিংহদুয়ার বন্ধ করে দেন। শেষে হাঁড়িভরা রসগোল্লা নিয়ে ভগবান তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীর মান ভাঙিয়ে তবে মন্দিরে ঢুকতে পারেন। একাদশ শতাব্দীতে সাদা বর্ণের কারণে এটি ক্ষীর মোহন নামে পরিচিত ছিল। এই কারণে ছানা থেকে তৈরি মিষ্টি দিয়ে মহা লক্ষ্মীর ভোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে রথ যাত্রার শেষ দিনে। যদিও বহুদিন ধরে এটি তৈরির পদ্ধতি মন্দির দ্বারা গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মন্দিরের বাইরে এটি কিভাবে পৌঁছেছে তা জানা সত্যিই মুশকিল।কিন্তু লোকে বিশ্বাস করেন, মন্দিরের একজন পন্ডিত যখন দেখলেন যে, মন্দিরের আশেপাশের গ্রামে অতিরিক্ত দুধ উৎপাদনের কারণে তা অপচয় হয়। তখন তিনি লোকেদের দুধ থেকে ছানা কাটার ও তা থেকে রসগোল্লা তৈরি করতে শিখিয়েছিলেন।।অর্থাৎ উড়িষ্যার মানুষ জনের মতে রসগোল্লার আবিষ্কারক তারা।
বাঙালিদের মতে রসগোল্লার আবিষ্কারক
বাঙালিদের মতে রসগোল্লার আবিষ্কারক হলেন কলকাতার নবীন চন্দ্রদাস। তিনি ১৮৬৮ সালে রসগোল্লা আবিষ্কার করেছিলেন এবং যা তাঁর পরের পর প্রজন্ম দ্বারা এগিয়ে যেতে থাকে। ১৮৬৪ সালে নবীন চন্দ্র রায় জোড়াসাঁকোয় প্রথম তাঁর একটি মিষ্টির দোকান খুলেছিলেন। তবে বেশিদিন না চলায় তিনি সেটি ১৮৬৬ সালে বন্ধ করে দেন। পরে বাগবাজারে ও তিনি একটি মিষ্টির দোকান চালু করেছিলেন।এখানে তার প্রথম মিষ্টি ছিল সন্দেশ। সেখানেই দুই বছর চেষ্টা করে তিনি তৈরি করেন রসগোল্লা। তাঁর অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে তখন বলেছিলেন যে, তাঁদের এই মিষ্টির পদ্ধতিটি নিজের নামে পেটেন্টকরিয়ে নেওয়া উচিত হবে। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হয় নি। বরং উল্টে তিনি কিভাবে এটি তৈরি করেন তা অনেক লোককে যেচে জানিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তার উদ্ভাবনা তখনই সফল হবে যখন এটি সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। এন সি দাসের এই আবিষ্কারটি বাঙ্গালীদের কাছে খুব বিখ্যাত হয়েছিল। সেদিক থেকে বলতে গেলে বাংলার রসগোল্লার জনক শ্রী নবীনচন্দ্র দাস। নিজের রসগোল্লা যার জন্য বাঙালি প্রাণপাত করতেও রাজি সেই রসগোল্লার ইতিহাস এখনো ডবল সেঞ্চুরি করতে পারেনি।
বর্তমান নাগরিক জীবনে রসগোল্লা
বর্তমান নাগরিক জীবনে রসগোল্লা ছাড়া বাঙালির উৎসব পার্বণ ঠিক জমে ওঠেনা। বাংলাদেশ, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের রসগোল্লার মধ্যে বাঙালির রসগোল্লায় বেশ কিছু মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলায় ছানা দিয়ে তৈরি নরম ও স্পঞ্জরসগোল্লা। এটি মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই গলে যায়। বাংলায় রসগোল্লা তৈরিতে ময়দা ও সুজি একেবারেই ব্যবহার করা হয় না। এতে মিষ্টত্ব আনার জন্য চিনির রসে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই এটি দেখতে ধবধবে সাদা রঙের হয়। অন্যদিকে, উড়িষ্যার রসগোল্লার বৈশিষ্ট্য হল ক্ষীর ও সুজির ব্যবহার, লাল রং এবং মোটা বা গাঢ় রস। সেখানে মিষ্টির স্বাদ আনতে গুড়ের ব্যবহার করা হয়।
জি আই স্ট্যাটাস
বিভিন্ন যুক্তি তর্কের রশি টানাটানি শেষে পশ্চিমবঙ্গ ২০১৫ সালে রসগোল্লার জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশনের জন্য আবেদন করে এবং তা ২০১৭ সালের ১৪ই নভেম্বর বাংলার রসগোল্লা নামে জি আই স্ট্যাটাস লাভ করে। উড়িষ্যা ২০১৮ সালে নিজেদের রসগোল্লার জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশনের জন্য আবেদন করে এবং ২৯শে জুলাই ২০১৯ সালে আলাদা ভাবে উড়িষ্যার রসগোল্লা হিসাবে জি আই স্ট্যাটাস লাভ করে। রসগোল্লা যে শুধুমাত্র শেষ পাতে মুখ মিষ্টি করে তাই নয় রসগোল্লার উপকারিতা ও রয়েছে। রসগোল্লা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়।রসগোল্লায় ছানা থাকায় এ থেকে প্রোটিন পাওয়া যায়।এছাড়া রসগোল্লায় ওমেগা থ্রিফ্যাটি এসিড থাকায় হার্টের সমস্যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ও এটি সাহায্য করে। এক্ষেত্রে গরম মিষ্টি খাওয়ার উপকারিতা সবথেকে বেশি।
রসগোল্লা রেসিপি
রসগোল্লা বানানো মোটেই কোনো কঠিন কাজ নয়।
উপকরণ
দুধ- ১.৮ লিটার
চিনি – ৫০০ গ্রাম
গুঁড়ো চিনি – হাফ কাপ
পাতিলেবু- ১টি
পরিষ্কার সুতির কাপড়
পদ্ধতি
প্রথমেই দুধ একটি পাত্রে নিয়ে খুব ঘন করে ফুটিয়ে নিতে হবে। দুধ ঘন হয়ে এলে লেবুর রস দিয়ে ছানা তৈরি করে নিতে হবে। এইবারসুতির কাপড়ে ছানাটি বেধে জল ঝরিয়ে নিতে হবে। তারপর ভালোভাবে ছানাটি মেখে একটি ছড়ানো পাত্রে রাখতে হবে। কিছুক্ষণ পর মাখা ছানার মধ্যে গুঁড়ো চিনি মিশিয়ে ৫- ৭ মিনিট মাখতে হবে। দেখতে হবে যেন মাখাটা মসৃণ হয়। এইবার সেখান থেকে ছোট ছোট আকারে ছানা নিয়ে হাতের তালুতে পাকিয়ে বল তৈরি করে রাখতে হবে। সেই সাথে আর একটি বড় পাত্রে চিনি মিশিয়ে জল ফুটিয়ে রসগোল্লার রস তৈরি করে নিতে হবে। রসগোল্লার শিরা বা রস ভালোভাবে তৈরি হয়ে গেলে, ছানার বলগুলি রসের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে ৯ – ১০ মিনিট ধরে ফোটাতে হবে। এবার উনুনের আঁচ কমিয়ে ৩০ মিনিট রেখে দিতে হবে। তারপর আঁচ থেকে নামিয়ে ৫ – ৬ ঘন্টা রেখে দিতে হবে। তারপর ঠান্ডা হয়ে গেলে কিংবা উষ্ণ গরম অবস্থায় তা পরিবেশন করা যাবে।
নলেন গুড়ের লাল রসগোল্লা রেসিপি
নলেন গুড়ের রসগোল্লা বানাতে সাদা রসগোল্লার মতোই উপকরণ প্রয়োজন হয়। তবে এক্ষেত্রে সামান্য কিছু উপকরণ অতিরিক্ত দরকার হয়ে থাকে।
উপকরণ
দুধ- ১ লিটার
টক দই- ১ কাপ
সুজি- ২চামচ
ভোজ্য তেল- ১ চামচ
চিনি- ২ কাপ
নলেন গুড়- ৫০০ গ্রাম
এক টুকরো সুতির কাপড়
পদ্ধতি
প্রথমেই দুধ ফুটিয়ে তাতে দই ফেলে ছানা বানিয়ে নিতে হবে। ছানা আর সবুজাভ জল আলাদা হয়ে গেলে আঁচ থেকে নামিয়ে ছাকনির উপর সুতিরকাপড় রেখে ছানা থেকে জল ঝেড়ে নিতে হবে। এবার ছানাটিকে একটি ছড়ানো পাত্রে নিয়ে তেল, সামান্য চিনি ও সুজি মিশিয়ে ভাবে মেখে নিতে হবে। ছানা মসৃন না হওয়া পর্যন্ত মাখতে হবে। তারপর চান কে টুকরো করে পরিমাপ মতো নিয়ে হয়ে তালুতে পাকিয়ে গোল গোল বল বানিয়ে নিতে হবে। সেই সাথে গুড় জলের সাথে মিশিয়ে আঁচে বসিয়ে রসগোল্লার সিরা বানিয়ে নিতে হবে। সিরা টগবগ করে ফুটতে শুরু হলে ছানার বলগুলি তার মধ্যে দিয়ে ১০- ১৫ মিনিটের জন্য ভালো করে ঢেকে দিতে হবে। বল গুলি ফুলে বড় বড় হয়ে গেলে আঁচ থেকে নামিয়ে ৫ – ৬ ঘন্টা সিরাতেভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর রস ঠাণ্ডা হযে এলে রসগোল্লা পরিবেশন যোগ্য হয়ে উঠবে।তবে বাজার জাত সাদা রসগোল্লার থেকে নলেন গুড়ের রসগোল্লার দাম সাধারণত একটু বেশি হয়ে থাকে।